জরায়ু টিউমার কি এবং জরায়ু টিউমারের লক্ষণ

বর্তমানে জরায়ু টিউমার নারীদের মাঝে একটি সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা। এটি নারীদের জরায়ুতে দেখা দেয়। এই টিউমারগুলো জরায়ুর টিস্যুতে অস্বাভাবিক কোষের বৃদ্ধির কারণে হয় এবং বিভিন্ন আকারের হয়ে থাকে। বর্তমান সময়ে নারী স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য জরায়ু টিউমার সম্পর্কে বিস্তারিত জানা অত্যন্ত জরুরি।

তাই আজকের এই পোস্টে জরায়ু টিউমার কি, জরায়ু টিউমারের কারণসমূহ, জরায়ু টিউমারের লক্ষণ সমূহ এবং জরায়ু টিউমার প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

জরায়ু টিউমার কি?

জরায়ু টিউমার হলো জরায়ুর মধ্যে থাকা কোষগুলোর অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি। জরায়ুতে টিউমার সাধারণত দুই ধরনের হতে পারে:

  • সৌম্য (Benign) টিউমার
  • দূষিত (Malignant) টিউমার

সৌম্য (Benign) টিউমার: এটি ক্যান্সারের কারণ নয় এবং সাধারণত এটি খুব ধীরে বাড়ে। যেমন- ফাইব্রয়েড টিউমার, যা মহিলাদের মধ্যে খুব সাধারণ। ফাইব্রয়েড সাধারণত জরায়ুর মধ্যে মাংসপেশির কোষের অতিরিক্ত বৃদ্ধি থেকে হয় এবং এটি ক্যান্সারে রূপান্তরিত হয় না।

দূষিত (Malignant) টিউমার: এটি ক্যান্সারের কারণ হতে পারে এবং দ্রুত ছড়িয়ে যেতে পারে। যেমন- জরায়ু ক্যান্সার যা জরায়ুর কোষের মধ্যে তৈরি হয় এবং এটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে।

জরায়ুর টিউমার বিভিন্ন উপসর্গের মাধ্যমে প্রকাশ পেতে পারে, যেমন অতিরিক্ত ঋতুস্রাব, ঋতুস্রাবের মাঝে রক্তপাত, তলপেটে ব্যথা, প্রস্রাবে সমস্যা ইত্যাদি।

আরো পড়ুনঃ ব্রেস্ট টিউমার কি? ব্রেস্ট টিউমার হওয়ার কারণ এবং চিকিৎসা

জরায়ুতে টিউমার কেন হয়?

জরায়ুতে টিউমার হওয়ার সঠিক কারণ এখনও পুরোপুরি জানা যায়নি। তবে কিছু সাধারণ কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। নিচে জরায়ুতে টিউমার হওয়ার কিছু সাধারণ উল্লেখ করা হলো:

হরমোনের ভারসাম্যহীনতা: স্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরনের মতো হরমোন জরায়ুর কোষ বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলে। বয়ঃসন্ধিকাল থেকে মেনোপজ পর্যন্ত এই হরমোনগুলোর মাত্রা ওঠানামা করে। এই হরমোনের মাত্রা বেড়ে গেলে জরায়ুর কোষ বাড়তে থাকে এবং টিউমার সৃষ্টি হতে পারে।

বংশগত কারণ: পরিবারে কারও জরায়ুতে টিউমার থাকার ইতিহাস থাকলে অন্য সদস্যদেরও এই সমস্যা হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। অর্থাৎ, জিনগত কারণেও এটি হতে পারে।

অতিরিক্ত ওজন ও জীবনধারা: অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা জরায়ুতে টিউমারের ঝুঁকি বাড়ায়। তাছাড়া, ব্যায়ামের অভাব এবং অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার অভ্যাসও এই সমস্যার জন্য দায়ী হতে পারে।

বয়স: বয়স বাড়ার কারণেও জরায়ু টিউমার হতে পারে। বিশেষ করে ৩০ থেকে ৪০ বছরের নারীদের মধ্যে ফাইব্রয়েডের প্রবণতা বেশি দেখা যায়।

জরায়ু টিউমারের লক্ষণ

জরায়ু টিউমারের বিভিন্ন লক্ষণ দেখা দিতে পারে এবং এই লক্ষণগুলো কেমন হবে তা টিউমারের আকার, অবস্থান, এবং প্রকারের ওপর নির্ভর করে। নিচে কিছু জরায়ু টিউমারের লক্ষণ তুলে ধরা হলো:

  • পিরিয়ডের সময় অধিক রক্তক্ষরণ
  • তলপেটে বা কোমরের নিচে চাপ ও ব্যথা
  • প্রস্রাবের চাপ ও জটিলতা
  • পেট ফুলে ওঠা বা আকারে বৃদ্ধি
  • যৌনমিলনের সময় ব্যথা
  • পেটের নিম্নাংশে ব্যথা
  • ওজনহীনতা বা ক্লান্তি

পিরিয়ডের সময় অধিক রক্তক্ষরণ: জরায়ু টিউমারের অন্যতম প্রধান লক্ষণ হলো পিরিয়ডের সময় অত্যধিক রক্তক্ষরণ হওয়া। অনেকে একে সাধারণ পিরিয়ড সমস্যা বলে ভাবতে পারেন, কিন্তু অতিরিক্ত রক্তপাত এবং দীর্ঘ সময় ধরে চলা পিরিয়ড জরায়ু টিউমারের লক্ষণ হতে পারে।

তলপেটে বা কোমরের নিচে চাপ ও ব্যথা: টিউমারের আকার বড় হলে তলপেটে চাপ বা ভার অনুভব হতে পারে। এটি প্রায়শই একটি ব্যথা বা অস্বস্তির অনুভূতি সৃষ্টি করে যা কোমর, পিঠ, বা পায়ের দিকে ছড়িয়ে পড়তে পারে। যদি তলপেটে দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা অনুভব করেন তবে এটি জরায়ু টিউমারের লক্ষণ হতে পারে।

প্রস্রাবের চাপ ও জটিলতা: জরায়ু টিউমারটি মূত্রথলির উপর চাপ প্রয়োগ করলে বারবার প্রস্রাবের চাপ অনুভূত হতে পারে। ঘনঘন মূত্রত্যাগের ইচ্ছা বা প্রস্রাব করার সময় ব্যথা হলে এটি জরায়ু টিউমারের লক্ষণ হতে পারে।

যৌনমিলনের সময় ব্যথা: জরায়ু টিউমারের কারণে যৌনমিলনের সময় ব্যথা হতে পারে। এটি সাধারণত টিউমারের অবস্থান ও আকারের ওপর নির্ভর করে। এই ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হলে অবিলম্বে চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করা উচিত।

পেটের নিম্নাংশে ব্যথা: জরায়ু টিউমারের ক্ষেত্রে অনেকেই পেটের নিম্নাংশে ব্যথা অনুভব করেন। টিউমারের আকার বড় হলে এটি আশেপাশের অঙ্গপ্রত্যঙ্গে চাপ ফেলে, যার ফলে এই ব্যথার সৃষ্টি হয়ে থাকে।

ওজনহীনতা বা ক্লান্তি: জরায়ু টিউমারের কারণে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হলে শরীরের লোহিত রক্তকণিকার সংখ্যা কমে যেতে পারে, যা থেকে অ্যানিমিয়া বা রক্তাল্পতা তৈরি হয়। এর ফলে রোগীরা দুর্বলতা বা ক্লান্তি অনুভব করে থাকেন।

জরায়ু টিউমার মহিলাদের জন্য সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা হলেও সচেতন থাকা অত্যন্ত জরুরি। উপরে উল্লেখিত লক্ষণগুলোর মধ্যে যদি কোনোটি নিজের মধ্যে অনুভব করে থাকেন তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে দ্বিধা করবেন না।

জরায়ু টিউমার প্রতিরোধের উপায়

জরায়ু টিউমার নারীদের জন্য শারীরিক ও মানসিক কষ্টের কারণ হতে পারে। তবে কিছু সাধারণ স্বাস্থ্য সচেতনতা ও জীবনযাপনের পরিবর্তন আনলে এই টিউমার প্রতিরোধ করা সম্ভব। নিচে জরায়ু টিউমার প্রতিরোধের কিছু কার্যকর উপায় নিয়ে আলোচনা করা হলো:

স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন: জরায়ু টিউমার প্রতিরোধের অন্যতম প্রধান উপায় হলো স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন। নিয়মিত ব্যায়াম এবং সুষম খাদ্যাভ্যাস বজায় রেখে শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা অত্যন্ত জরুরি। অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা জরায়ু টিউমারসহ বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।

সুষম খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ করা: সুষম ও পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ জরায়ু টিউমারের ঝুঁকি কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। খাদ্যতালিকায় প্রচুর সবজি, ফলমূল, শস্যজাতীয় খাবার এবং স্বাস্থ্যকর চর্বি যেমন অলিভ ওয়েল, বাদাম এবং সামুদ্রিক মাছ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এই ধরনের খাবার শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং টিউমার সৃষ্টিকারী কোষগুলোর বৃদ্ধি প্রতিরোধে সাহায্য করে।

শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা: শরীরের অতিরিক্ত ওজনও জরায়ু টিউমারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। তাই নিয়মিত ব্যায়াম করা এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা অত্যন্ত জরুরি। অতিরিক্ত ওজন থাকলে হরমোনের ভারসাম্য বিঘ্নিত হতে পারে, যা টিউমার বৃদ্ধির কারণ হতে পারে।

হরমোনাল ভারসাম্য রক্ষা: হরমোনাল ভারসাম্যের অভাব অনেক সময় জরায়ু টিউমারের কারণ হতে পারে। ওজন নিয়ন্ত্রণ, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এবং মানসিক চাপ কমানোর মাধ্যমে হরমোনাল ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব। অনেক সময় জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল গ্রহণ করাও হরমোনে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করতে পারে। তাই এ বিষয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

মানসিক চাপ কমানো: মানসিক চাপ শরীরের নানা ধরনের হরমোনাল পরিবর্তনের কারণ হয়ে থাকে যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল করে। প্রতিদিন ৮ ঘণ্টা ঘুমানো, মেডিটেশন করা এবং শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকা মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে। মানসিক চাপ কমালে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং জরায়ু টিউমারের ঝুঁকি অনেকটা হ্রাস পায়।

নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা: জরায়ু টিউমার প্রতিরোধে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে যাদের পরিবারে টিউমারের ইতিহাস আছে, তাদের নিয়মিত চেকআপ করা জরুরি। মহিলাদের বছরে অন্তত একবার প্যাপ স্মিয়ার এবং আলট্রাসাউন্ডের মাধ্যমে জরায়ু পরীক্ষা করা উচিত।

জরায়ু টিউমার প্রতিরোধের জন্য স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, সুষম খাদ্যাভ্যাস, এবং মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জরায়ু টিউমারের ঝুঁকি হ্রাস করা সম্ভব।

শেষ কথা

প্রিয় পাঠক, আজকের এই পোস্টে জরায়ু টিউমার কি, জরায়ু টিউমারের কারণসমূহ, জরায়ু টিউমারের লক্ষণ এবং জরায়ু টিউমার প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। আশাকরি, পোস্টটি পড়ে একটু হলেও উপকৃত হয়েছেন এবং অজানা বিষয়গুলো জানতে পেরেছেন।

পোস্টটি যদি ভালো লেগে থাকে তাহলে আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না। এরকম নিত্যনতুন তথ্য পেতে SR TechZone ওবেবসাইটের সাথেই থাকুন।

FAQ’s

মহিলাদের জরায়ুতে টিউমার কেন হয়?

মহিলাদের জরায়ুতে টিউমার হওয়ার সঠিক কারণ এখনো পুরোপুরি জানা যায়নি। তবে কিছু কারণকে এর সাথে জড়িত করা হয়, যেমন: হরমোন, জিনগত কারণ, বয়স, শরীরের ওজন, রক্তচাপ।

জরায়ু টিউমার মানেই কি ক্যান্সার?

না, জরায়ু টিউমার মানেই ক্যান্সার নয়। অনেক টিউমার বিনাইন (নিরাপদ) হয়ে থাকে, যা ক্যান্সারে রূপান্তরিত হয় না। তবে কিছু টিউমার ম্যালিগন্যান্ট (ক্যান্সারজনিত) হতে পারে।

জরায়ু টিউমারের লক্ষণ কি কি?

জরায়ু টিউমারের লক্ষণগুলো বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। তবে কিছু সাধারণ লক্ষণ রয়েছে, যেমন: অস্বাভাবিক যোনি রক্তস্রাব, পেটের নিচে ব্যথা বা চাপ অনুভূত হওয়া, যৌন সম্পর্কের সময় ব্যথা, পিরিয়ডের সময় অধিক রক্তক্ষরণ ইত্যাদি।

Leave a Comment